অভাবের ঘরে স্বপ্ন চাষ
লেখা: Md. Mostafijur Rahman আইন বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। আমার বাবার নাম মরহুম সাধু শেখ। আমার পরিবারের উপর কালো মেঘ হানা দেয় ২০০৭ সালে, ঐ সালটি যেন আমার পরিবারের জন্য একটা ঝড়ের মতোই। বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। পারিবারিক অবস্থাও খুব একটু ভালো নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই মরণব্যাধি ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা করাটা একপ্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার! তবুও বাবার চিকিৎসা করার জন্য আমার পরিবার ও আত্তীয়রা যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেন।কিন্তু এই মরণব্যাধি রোগের যথেষ্ট চিকিৎসা না পাওয়ার কারনে অকালেই পাড়ি জমান মুক্ত আকাশে (পরপারে), আমাদের দুই ভাইকে এতিম করে। আমার বয়স হয়তো ৪/৫ বছর এবং একমাত্র ছোট ভাই সাগরের বয়স ২/৩ বছর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনাক্ষম বাবা না থাকায়, পরিবারের হাল ধরেন আমার আম্মু। আম্মু মানুষের (মৌসুম ভিত্তিক) মরিচ উঠানো আর ভূট্টা তুলে সংসার চালাতে থাকেন।ততোদিনে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। অভাব অনটনে থাকলেও মায়ের তীব্র ইচ্ছে ছিল আমাদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবেন। মায়ের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়, যদিও সামর্থ্য ততটুকু ছিল না। তবে মনে ছিল দুঃসাধ্যকে সাধন করার মতো অসম্ভব ধৈর্যশক্তি। আমার কাছে আমার মা হলো সেরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, শিক্ষক ও দার্শনিক, আমার মা বর্তমানকে নয় ভবিষ্যতকেই প্রাধান্য দেন। শরৎ নগর সরকারি প্রা. বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে পিইসি পরীক্ষা দিয়ে ব্যাচের মধ্যে সর্বোচ্চ রেজাল্ট অর্জন করলেও জিপিএ ছিল মাত্র ৪.১৭। ভর্তি হলাম গিরিশ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে । যমুনা নদী পার হয়ে স্কুল যেতাম, বর্ষার সময় এক হাটু কাঁদা আর গ্রীষ্মের সময় কাদার পরিবর্তে মাথার উপর প্রখর রৌদ্রকে উপেক্ষা করে বালুচরের মধ্যে দিয়েই প্রতিদিন সকাল ৮ টায় বাড়ি থেকে বের হতাম আর বাড়িতে ফিরতে বিকাল ৩/৪ টা বেজে যেতো। এভাবেই পড়ালেখা করে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণীতে পদার্পণ করলাম ‘খ’ শাখা থেকে প্রথম স্হান অধিকার করে কিন্তু ঐ বছর শিক্ষকেরা ‘ক’ ও ‘খ’ শাখা একত্রিত করায় আমার রোল মোট নম্বরের ভিত্তিতে পঞ্চম (৫) হয়ে গেল। কিছু বড় ভাইয়েরা আমার পারিবারিক অবস্হার কথা বিবেচনা করে বললেন, তোমার তো রোল ৫ হয়েছে অর্ধ বেতনে পড়ালেখার সুযোগ চেয়ে তুমি প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি আবেদন পত্র লিখো, ( প্রথম স্হান অর্জন করলে হয়তো ফুল ফ্রী পড়াতেন) তোমাকে অর্ধ বেতনে পড়তে সুযোগ দেবেন মনে হয়। তাদের কথামত আবেদন লিখলাম,আবেদন পত্র নিয়ে অফিসের সামনে যেতেই শ্রদ্ধীয় প্রধান শিক্ষক (আব্দুল হাকিম মন্ডল) আমাকে দেখে বললেন “মোস্তফা কি নিয়ে আসছো”?… আমি তাঁর কাছে আবেদন পত্রটি দিলাম আর বললাম অর্ধবেতনে পড়ার সুযোগের জন্য একটি আবেদন পত্র লিখে নিয়ে আসছি। উনি আমার কথা শুনে আবেদন পত্রটি হাতে নিয়েই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন ” তুমি ফুল ফ্রী “! আমি কি বলবো কিছু বুঝতেছিলাম না। ক্লাসের দিকে চলে গেলাম আর বেঞ্চে বসে নিজের অজান্তেই দু’ফোটা পানি ফেললাম। কিছু দিন পরে উনি আরো বললেন তোমার কথা আমি নৌকার মাঝিদের বলেছি তারা আর তোমার থেকে ভাড়ার টাকা নিবেন না। খেয়াঘাটে শাহালী চাচার চায়ের দোকান আছে, নৌকা না পেলে আমি শীতকালে মাঝে মাঝে উনার দোকান থেকে চা খেতাম। হঠাৎ একদিন চা খেলাম আর তিনি আমার থেকে টাকা নিলেন না। বললেন বাবা তুমি আজ থেকে আমার দোকানের যা কিছু খাবে সব ফ্রি। লজ্জায় পড়েগেলাম উনার পুঁজি খুবই সামন্য তবুও আমাকে এভাবে খেতে বলতেছেন। আমি আর উনার দোকানের কাছেই যাই না, একদিন আমি নৌকা থেকে নামতেই জোরে ডাক দিলেন। কাছে গেলাম উনি বললেন বাবা তুমি তো আর আমার দোকান থেকে কিছু খাচ্ছো না? তোমার থেকে টাকা নিতে ইচ্ছে করে না বাবা,তুমি খেলেই মনের ভিতর একটা শান্তি আসে। তুমি আর চা খাও না এজন্য কষ্ট পেয়েছি। কাল থেকে তুমি আগের মতোই প্রতিদিন এক কাপ চা খেয়ে যাবে। কথাগুলো শুনে কিছু না বলেই বাড়িতে চলে গেলাম। তারপর থেকে উনার দোকানে মাঝে মাঝে চা খাই, না খেলে যদি আবার কষ্ট পায় এই ভয়ে। আমার জীবনে এতো মানুষের অবদান আছে যাদের নাম কোন খাতায় লিখলেও পাতা শেষ হবে তবুও নাম শেষ হবে না। আমি তো শাহালী চাচার এক কাপ চায়ের ঋণও কোনদিন দিতে পারব না, বাকীদের কথা বাদই দিলাম। তাঁদের উৎসাহ দেখে নিজেই অবাক হলাম আমি তো এতো ভালো স্টুডেন্ট না! একটু একটু করে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে লাগল। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেনীতে দ্বিতীয় স্হান অর্জন করলাম (ইংরেজিতে খুব কম নম্বর পাওয়ার কারনেই প্রথম স্হান অর্জন করতে পারিনি)। অষ্টম শ্রেণিতে উঠে পড়ালেখায় আরো বেশি সিরিয়াস হলাম। ২০১৭ সালে চরগিরিশ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে ব্যাচের মধ্যে আমি একাই জিপিএ ৫.০০ পেলাম। সবাই অনেক খুশি হলেন। এবার এলাকার মানুষের সুনজরে পড়লাম। বিশেষ করে স্যারেরা খুব খুশি হলেন। অনেকে বলল সাইন্স( বিজ্ঞান) নিয়ে পড়ালেখা করো, জীবনে ভালো কিছু হতে পারবে। তবে গুটি কয়েক লোকজন বলল তুমি আর্টস (মানবিক) নিয়ে পড়ালেখা করো। যেহেতু টাকা পয়সাও তেমন নাই, সাইন্স নিলে প্রাইভেট পড়তেই হয় তাছাড়া নদী পারাপার হতেই অনেক সময় চলে যায়। সাইন্সে পড়লে নাকি অনেক বেশি পড়তে হয়। সবার পরামর্শ শুনে বোঝা গেল ৯০% মানুষই বলল সাইন্স নাও আর মাত্র ১০% মানুষ বলল আর্টস নাও। আমাকে মাসুদ বিএসসি স্যার( রিপন স্যার) বলল তুমি আর্টসই নাও, বিভাগ কোন বিষয়ই নয়। তুমি ভালো করে পড়লে যেকোন বিভাগ থেকেই ভালো কিছু হতে পারবে। সকল স্যারেরা সম্মতি দিল আর্টসই ভালো হবে।পরিশেষে মানবিক শাখা নিয়েই পড়ালেখা করলাম। ইতিমধ্যে হাসান স্যার( বিডিআর) আমার সাথে কথা বলতে চরগিরিশ স্কুলের মাঠে চলে আসছেন, সাথে বেলাল ভাই ও আবিদ হাসান ভাইকেও দেখলাম। উনি আসছেন আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে ” রাবেয়া ফাউন্ডেশন ” থেকে বৃত্তি প্রদান করবেন। উনার কথামত আবেদন করলাম এবং পরের মাস থেকেই বৃত্তি (৭৫০৳) দেওয়া শুরু করলেন। বৃত্তির টাকা দিয়ে প্রাইভেট ও খাতাপত্র ক্রয়ে ব্যয় করতে লাগলাম। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এখনো এই ফাউন্ডেশন আমার পাশে আছেন,তবে মাঝে দু’বছরের মতো বৃত্তি স্থগিত ছিল। নবম শ্রেণির শেষের দিকে আমি বুঝতে পারলাম আমার পড়ালেখায় অনেক ঘাটতি আছে। মাকে বুঝিয়ে গুলের মোড়ে একটি বাড়িতে থাকা শুরু করলাম। একমাস যেতে না যেতেই বুঝলাম বাইরে থাকা খাওয়া আর অন্যান্য খরচ মিলে আমার মায়ের পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি গেলাম কোন এক অজুহাতে গিয়ে দেখি জাহাঙ্গীর কাকা আমাদের বাড়িতে আসছেন। কথাপ্রসঙ্গে কাকা মা কে বলল আপনার ছেলে দেখি পশ্চিম দিক থেকে স্কুলে আসে ……. । পরে বিষয়টা উনি বুঝতে পারলেন এবং বললেন ভাতিজা কাল থেকে আমার বাড়িতে থাকবে,আমরা বেঁচে থাকতে ভাতিজা মাইনষ্যের বাড়িতে থাকবে এটা তো লজ্জার বিষয়। তারপর চলে আসলাম জাহাঙ্গীর কাকার বাড়িতে, নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার তখনো ৩ মাস বাকি ছিল। পড়ালেখায় খুব মনোযোগী হলাম, আমার আবার রাতের পড়ার অভ্যাস নাই, সারাদিন যতটুকু সময় পাই পড়ালেখা করি আর বিকালে একটু নদীর পারে হাটাহাটি