লেখা: Md. Mostafijur Rahman
আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। আমার বাবার নাম মরহুম সাধু শেখ। আমার পরিবারের উপর কালো মেঘ হানা দেয় ২০০৭ সালে, ঐ সালটি যেন আমার পরিবারের জন্য একটা ঝড়ের মতোই। বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। পারিবারিক অবস্থাও খুব একটু ভালো নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই মরণব্যাধি ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা করাটা একপ্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার! তবুও বাবার চিকিৎসা করার জন্য আমার পরিবার ও আত্তীয়রা যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেন।কিন্তু এই মরণব্যাধি রোগের যথেষ্ট চিকিৎসা না পাওয়ার কারনে অকালেই পাড়ি জমান মুক্ত আকাশে (পরপারে), আমাদের দুই ভাইকে এতিম করে। আমার বয়স হয়তো ৪/৫ বছর এবং একমাত্র ছোট ভাই সাগরের বয়স ২/৩ বছর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনাক্ষম বাবা না থাকায়, পরিবারের হাল ধরেন আমার আম্মু। আম্মু মানুষের (মৌসুম ভিত্তিক) মরিচ উঠানো আর ভূট্টা তুলে সংসার চালাতে থাকেন।ততোদিনে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। অভাব অনটনে থাকলেও মায়ের তীব্র ইচ্ছে ছিল আমাদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবেন। মায়ের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়, যদিও সামর্থ্য ততটুকু ছিল না। তবে মনে ছিল দুঃসাধ্যকে সাধন করার মতো অসম্ভব ধৈর্যশক্তি। আমার কাছে আমার মা হলো সেরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, শিক্ষক ও দার্শনিক, আমার মা বর্তমানকে নয় ভবিষ্যতকেই প্রাধান্য দেন।
শরৎ নগর সরকারি প্রা. বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে পিইসি পরীক্ষা দিয়ে ব্যাচের মধ্যে সর্বোচ্চ রেজাল্ট অর্জন করলেও জিপিএ ছিল মাত্র ৪.১৭। ভর্তি হলাম গিরিশ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে । যমুনা নদী পার হয়ে স্কুল যেতাম, বর্ষার সময় এক হাটু কাঁদা আর গ্রীষ্মের সময় কাদার পরিবর্তে মাথার উপর প্রখর রৌদ্রকে উপেক্ষা করে বালুচরের মধ্যে দিয়েই প্রতিদিন সকাল ৮ টায় বাড়ি থেকে বের হতাম আর বাড়িতে ফিরতে বিকাল ৩/৪ টা বেজে যেতো। এভাবেই পড়ালেখা করে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণীতে পদার্পণ করলাম ‘খ’ শাখা থেকে প্রথম স্হান অধিকার করে কিন্তু ঐ বছর শিক্ষকেরা ‘ক’ ও ‘খ’ শাখা একত্রিত করায় আমার রোল মোট নম্বরের ভিত্তিতে পঞ্চম (৫) হয়ে গেল।
কিছু বড় ভাইয়েরা আমার পারিবারিক অবস্হার কথা বিবেচনা করে বললেন, তোমার তো রোল ৫ হয়েছে অর্ধ বেতনে পড়ালেখার সুযোগ চেয়ে তুমি প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি আবেদন পত্র লিখো, ( প্রথম স্হান অর্জন করলে হয়তো ফুল ফ্রী পড়াতেন) তোমাকে অর্ধ বেতনে পড়তে সুযোগ দেবেন মনে হয়। তাদের কথামত আবেদন লিখলাম,আবেদন পত্র নিয়ে অফিসের সামনে যেতেই শ্রদ্ধীয় প্রধান শিক্ষক (আব্দুল হাকিম মন্ডল) আমাকে দেখে বললেন “মোস্তফা কি নিয়ে আসছো”?… আমি তাঁর কাছে আবেদন পত্রটি দিলাম আর বললাম অর্ধবেতনে পড়ার সুযোগের জন্য একটি আবেদন পত্র লিখে নিয়ে আসছি। উনি আমার কথা শুনে আবেদন পত্রটি হাতে নিয়েই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন ” তুমি ফুল ফ্রী “! আমি কি বলবো কিছু বুঝতেছিলাম না। ক্লাসের দিকে চলে গেলাম আর বেঞ্চে বসে নিজের অজান্তেই দু’ফোটা পানি ফেললাম। কিছু দিন পরে উনি আরো বললেন তোমার কথা আমি নৌকার মাঝিদের বলেছি তারা আর তোমার থেকে ভাড়ার টাকা নিবেন না। খেয়াঘাটে শাহালী চাচার চায়ের দোকান আছে, নৌকা না পেলে আমি শীতকালে মাঝে মাঝে উনার দোকান থেকে চা খেতাম। হঠাৎ একদিন চা খেলাম আর তিনি আমার থেকে টাকা নিলেন না। বললেন বাবা তুমি আজ থেকে আমার দোকানের যা কিছু খাবে সব ফ্রি। লজ্জায় পড়েগেলাম উনার পুঁজি খুবই সামন্য তবুও আমাকে এভাবে খেতে বলতেছেন। আমি আর উনার দোকানের কাছেই যাই না, একদিন আমি নৌকা থেকে নামতেই জোরে ডাক দিলেন। কাছে গেলাম উনি বললেন বাবা তুমি তো আর আমার দোকান থেকে কিছু খাচ্ছো না? তোমার থেকে টাকা নিতে ইচ্ছে করে না বাবা,তুমি খেলেই মনের ভিতর একটা শান্তি আসে। তুমি আর চা খাও না এজন্য কষ্ট পেয়েছি। কাল থেকে তুমি আগের মতোই প্রতিদিন এক কাপ চা খেয়ে যাবে। কথাগুলো শুনে কিছু না বলেই বাড়িতে চলে গেলাম। তারপর থেকে উনার দোকানে মাঝে মাঝে চা খাই, না খেলে যদি আবার কষ্ট পায় এই ভয়ে। আমার জীবনে এতো মানুষের অবদান আছে যাদের নাম কোন খাতায় লিখলেও পাতা শেষ হবে তবুও নাম শেষ হবে না। আমি তো শাহালী চাচার এক কাপ চায়ের ঋণও কোনদিন দিতে পারব না, বাকীদের কথা বাদই দিলাম। তাঁদের উৎসাহ দেখে নিজেই অবাক হলাম আমি তো এতো ভালো স্টুডেন্ট না! একটু একটু করে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে লাগল। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেনীতে দ্বিতীয় স্হান অর্জন করলাম (ইংরেজিতে খুব কম নম্বর পাওয়ার কারনেই প্রথম স্হান অর্জন করতে পারিনি)।
অষ্টম শ্রেণিতে উঠে পড়ালেখায় আরো বেশি সিরিয়াস হলাম। ২০১৭ সালে চরগিরিশ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষা দিয়ে ব্যাচের মধ্যে আমি একাই জিপিএ ৫.০০ পেলাম। সবাই অনেক খুশি হলেন। এবার এলাকার মানুষের সুনজরে পড়লাম। বিশেষ করে স্যারেরা খুব খুশি হলেন। অনেকে বলল সাইন্স( বিজ্ঞান) নিয়ে পড়ালেখা করো, জীবনে ভালো কিছু হতে পারবে। তবে গুটি কয়েক লোকজন বলল তুমি আর্টস (মানবিক) নিয়ে পড়ালেখা করো। যেহেতু টাকা পয়সাও তেমন নাই, সাইন্স নিলে প্রাইভেট পড়তেই হয় তাছাড়া নদী পারাপার হতেই অনেক সময় চলে যায়। সাইন্সে পড়লে নাকি অনেক বেশি পড়তে হয়। সবার পরামর্শ শুনে বোঝা গেল ৯০% মানুষই বলল সাইন্স নাও আর মাত্র ১০% মানুষ বলল আর্টস নাও। আমাকে মাসুদ বিএসসি স্যার( রিপন স্যার) বলল তুমি আর্টসই নাও, বিভাগ কোন বিষয়ই নয়। তুমি ভালো করে পড়লে যেকোন বিভাগ থেকেই ভালো কিছু হতে পারবে। সকল স্যারেরা সম্মতি দিল আর্টসই ভালো হবে।পরিশেষে মানবিক শাখা নিয়েই পড়ালেখা করলাম। ইতিমধ্যে হাসান স্যার( বিডিআর) আমার সাথে কথা বলতে চরগিরিশ স্কুলের মাঠে চলে আসছেন, সাথে বেলাল ভাই ও আবিদ হাসান ভাইকেও দেখলাম। উনি আসছেন আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে ” রাবেয়া ফাউন্ডেশন ” থেকে বৃত্তি প্রদান করবেন। উনার কথামত আবেদন করলাম এবং পরের মাস থেকেই বৃত্তি (৭৫০৳) দেওয়া শুরু করলেন। বৃত্তির টাকা দিয়ে প্রাইভেট ও খাতাপত্র ক্রয়ে ব্যয় করতে লাগলাম। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এখনো এই ফাউন্ডেশন আমার পাশে আছেন,তবে মাঝে দু’বছরের মতো বৃত্তি স্থগিত ছিল। নবম শ্রেণির শেষের দিকে আমি বুঝতে পারলাম আমার পড়ালেখায় অনেক ঘাটতি আছে। মাকে বুঝিয়ে গুলের মোড়ে একটি বাড়িতে থাকা শুরু করলাম। একমাস যেতে না যেতেই বুঝলাম বাইরে থাকা খাওয়া আর অন্যান্য খরচ মিলে আমার মায়ের পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি গেলাম কোন এক অজুহাতে গিয়ে দেখি জাহাঙ্গীর কাকা আমাদের বাড়িতে আসছেন। কথাপ্রসঙ্গে কাকা মা কে বলল আপনার ছেলে দেখি পশ্চিম দিক থেকে স্কুলে আসে ……. । পরে বিষয়টা উনি বুঝতে পারলেন এবং বললেন ভাতিজা কাল থেকে আমার বাড়িতে থাকবে,আমরা বেঁচে থাকতে ভাতিজা মাইনষ্যের বাড়িতে থাকবে এটা তো লজ্জার বিষয়। তারপর চলে আসলাম জাহাঙ্গীর কাকার বাড়িতে, নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার তখনো ৩ মাস বাকি ছিল। পড়ালেখায় খুব মনোযোগী হলাম, আমার আবার রাতের পড়ার অভ্যাস নাই, সারাদিন যতটুকু সময় পাই পড়ালেখা করি আর বিকালে একটু নদীর পারে হাটাহাটি ও মাঠে বসে বড় ভাইদের সাথে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতাম। এটা শুধু আড্ডা বললে ভুল হবে আমি এটাকে ছায়া প্রতিষ্ঠানই বলবো, যেখানে এক জন প্রশ্ন করতাম বাকিরা উত্তর দিতো……… ।
নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ৫৬ নম্বর বেশি পেয়ে প্রথম স্হান অর্জন করলাম এবং পুরো স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেলাম। দশম শ্রেণীর পুরো সময়টাই জাহাঙ্গীর কাকাদের বাড়িতেই থাকলাম, নদী পারাপার না হওয়ার কারনে পড়ালেখার সময় আগের তুলনায় বেশি পেলাম এবং সময়টাকে কাজেও লাগালাম। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় খাষরাজবাড়ি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় (যদিও পড়ালেখা করেছি চরগিরিশ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে) থেকে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে রাজশাহী বোর্ডে ৫৪ তম স্হান অর্জন করলাম। সবাই খুব খুশি হলো এবং কিছু মানুষ শহরে থেকে পড়ালেখার পরামর্শ দিলেন, শহরে আরো ভালো ভালো ছাত্র -ছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আরো বেশি পরিশ্রমী হওয়ার মানসিকতা তৈরি হবে। চয়েস দিলাম ভালো ভালো কলেজ গুলোতে, চান্স হলো কারমাইকেল কলেজে( রংপুর)। মোটামুটি সবাই যেতে না করল, কলেজটি অনেক দূরে হওয়ার কারনে। কিন্তু আমার মন শুধু বলে ঐটাই আমার জন্য ভালো হবে পাশে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাব। বরাবরই আমার নবম শ্রেণি থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল। উল্লেখ্য ঐসময় আমার চাচাতো ভাই শ্রদ্ধীয় শহিদুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বস্তুত উনার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে জানতে পারি আর আমার আগ্রহটাও বাড়তেছিল।
একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে রাখি, আমার একটা খুব বাজে অভ্যাস ছিল। আমি যা পড়ালেখা করতাম সেগুলো (কঠিন টপিক) মনে রাখার জন্য ক্লাসমেট অথবা সিনিয়রদের ঐগুলো থেকে প্রশ্ন করতাম। এটা করলে তারা হয়তো মনে মনে আমার প্রতি বিরক্ত হতো কিন্তু আমার ঐ পড়াগুলো মনের ভিতর গেঁথে যেতো সেটা আর ভুলে যাওয়ার উপায় ছিল না। যাইহোক চান্স পেলাম কারমাইকেল কলেজে মনের ভিতর যতটা না আনন্দ ছিল তার থেকে বেশি দুশ্চিন্তা ভর করতেছিল।মোটামুটি অধিকাংশ মানুষের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলাম কারমাইকেল কলেজে। এখান থেকেই যেন আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো….। মায়ের তো এতো টাকা নাই, মাসে মাসে টাকা পাঠানো মায়ের পক্ষে অসম্ভব। আমার চাচারা ও মামারা ছোট করে একটা মিটিং করলো আমাকে পড়ালেখা করাতে উনারাও সাহায্য করবেন। তাদের সাধ্য মতো কিছু কিছু টাকা দিলেন আর ফ্ল্যাট শেল্টার বাজারের দোকানদার ও প্রভাবশালী কিছু লোকের কাছে থেকে আমার জন্য টাকা উত্তোলন করা হলো। দেখা গেল ১১ হাজার টাকা হয়েছে, আমার ভর্তি ফি ছিল ২৯০০৳ বাকী টাকা আমাকে দেওয়া হলো রংপুরে গিয়ে ম্যাচের খরচ ও অন্যান্য খরচ চালিয়ে নেওয়ার জন্য। একদিন বিকালে শ্রদ্ধীয় বাধন ভাই আমার সাথে কথা বললেন এবং উনি আশ্বাস দিলেন একাদশ শ্রেণীর সকল বই উনি ক্রয় করে দিবেন। উনি টাকা দিলেন বই ক্রয় করে পড়ালেখা শুরু করলাম বাড়িতেই। তবে আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করবো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে আরো দু’জন ব্যক্তি উৎসাহিত করতো তারা হলেন রাশেদ স্যার (পাবিপ্রবি) ও রাকিব ভাই (ইবি)। যখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি, একদিন বিকালবেলা রাকিব ভাইকে বললাম, আচ্ছা আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই আগে থেকেই আমার কিভাবে পড়া উচিৎ? ভাই মুচকি হাসলেন আর বললেন এতো আগে পড়লে মনে থাকবে না তবে তুমি যদি চাও পড়াগুলো এগিয়ে রাখতে তাহলে appropriate preposition, synonym & antonyms word, Group verb…. etc এগুলো আগে থেকেই একটু একটু মুখস্থ করে রাখতে পারো। উনার কথামতো তখন থেকেই এগুলোর প্রতি একটু বেশি নজর দিলাম। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই রাশেদ স্যারের কাছে আইসিটি প্রাইভেট পড়তাম তখন স্যারের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জ থেকে ইংরেজির জন্য Master এবং জোবায়ের’ স জিকে বই দুটি ক্রয় করলাম। বইগুলো একটু একটু পড়তে লাগলাম। করোনার কারনে তখনো স্কুল/ কলেজ সব বন্ধ ই ছিল।
কিছুদিন পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হলো, আমিও রংপুরে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে এমন একটা ম্যাচে উঠলাম দিনের বেলাও রুমের মধ্যে কোন কিছু দেখা যেতো না এতটাই অন্ধকার ছিল। আসলে রুমে কোন জানালা ছিল না, মনে হয়েছিল রুমটা যেন ভূতের বাড়ি। এখানে গত কয়েক বছরেও কেউ থাকতো না। পরে অবশ্য রুম ছেড়ে আসার সময় জানতে পারি আসলেই ঐ রুমে অনেক দিন কেউ উঠে নাই। যাওয়ার পরেই শুনলাম এক মাস পরে আমাদের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা হবে। আমার পড়ালেখার অবস্হা মোটেও ভালো ছিল না। যেটুকু পড়েছিলাম তার বেশিরভাগই ছিল মাস্টার ও জিকে, একাডেমিক তো পড়ি নাই। কলেজের প্রথম দিন ক্লাসে গেলাম, গিয়ে দেখি স্যার ক্লাসে পড়নোর সময় যা প্রশ্ন করতেছে বাকী সবাই টপাটপ উত্তর দিচ্ছে আর আমি তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মনে হলো ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র আমি নিজেই। মেসে ফিরে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে পানি জমে গেল যে স্বপ্ন নিয়ে রংপুরে আসলাম আদৌ কি পূরণ হবে!!
এদিকে আমাকে দেওয়া সেই অবশিষ্ট ৮১০০৳ প্রথম মাসেই খরচ করে সামান্য কিছু টাকা আছে। টাকার টেনশন ও স্বপ্ন পূরনের অনিশ্চয়তায় আমি একেবারেই ভেঙে পড়লাম। পাশের রুম থেকে আমার বন্ধু তখন তার বাবাকে কল করে বলল “বাবা আমার টাকা লাগবে বিকালে টাকা পাঠিয়ে দিয়েন”। সেদিনই আমি আমার বাবাকে স্মরণ করে খুব কান্না করছিলাম। সবাই তো তাদের বাবার কাছে টাকা চাচ্ছে আমি তো আমার বাবাকে কল করে বলতে পারতেছি না ” বাবা টাকা পাঠিয়ে দেন”। ইতোমধ্যে আমি আমার পরিচিত সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ও শিক্ষকদের সাথে টাকার ব্যাপারে কথা বললাম। জরিপ করলে হিসাবটা সম্ভবত এমন হতো যে ২০ জনের কাছে টাকা চাইলে ৫ জন মুখের উপরই বলে দিতো টাকা নাই এতোদূরে পড়তে যেতে বলছে কারা? পড়াবাদ দিয়ে গার্মেন্টসে যাও। আমার চোখের পানি তখন টপটপ করে পড়তেছিল, যে পানি ঐপাশের মানুষটি দেখতে পারেন নাই। ৫ জন বলতো কয়েক দিনের মধ্যেই কিছু টাকা পাঠাবোনি কিন্তু তারা আর কখনোই আমার কল ধরতো না। ৫ জন বলতো কত টাকা লাগবে? তারা তাদের সাধ্যমতো টাকা পাঠাতে শুরু করল। আর বাকী ৫ জন আমার পড়ালেখার প্রতি খুবই আগ্রহ দেখালো এবং প্রতিমাসেই তাদের সাধ্যমতো টাকা পাঠাতে শুরু করলেন। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেওয়ার আগে কলেজে ৩০০০৳ দিতে হবে কিন্তু আমার কাছে তো এতো টাকা নাই। আমি অধ্যক্ষের সাথে দেখা করতে চাইলাম কিন্তু এক ভাই বললো তুমি বাংলা বিভাগের শহিদুল স্যারের সাথে এই বিষয়ে কথা বলো। আমি গেলাম তার বিভাগে কিন্তু উনি সেখানে নাই, পাশের স্যার বলল তুমি বসো,স্যার আসলে কথা বলিও, আমি বসলাম। পাশের চেয়ারে একজন ম্যাম ছিলেন তিনি ডাকলেন আর আমার সমস্যার কথা শুনলেন। বললেন” বাবা” এই টাকা তো সরকারের ফান্ডে জমা হবে এটা তো কম নেওয়ার সুযোগ নাই। তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাও…..। এই নাম্বারে বিকাশ আছে? বললাম জ্বি ম্যাম।তুমি আমার ছেলের মতো, মনে করো আমি তোমার মা। তোমার এই নাম্বারে আমি বিকালে টাকা পাঠিয়ে দেবো। তার কথা শুনে আমি কান্না করে ফেলেছি। উনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দেখো তেমার মতো অনেক গরিব পরিবার থেকে কষ্ট করে পড়ালেখা করে ভালো ভালো জায়গায় পৌঁছে গেছেন। তুমিও একদিন দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে নামকরা বিচারক হবে। বিচারক শব্দ টা শোনার পরেই কেমন যেন বুকের ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে গেল। কথা প্রসঙ্গে জানলাম ম্যামের শ্বশুর বাড়ি সিরাজগঞ্জে। প্রথম বর্ষ পরীক্ষা হলো, তারপর ডিসেম্বর মাস পুরোটাই কলেজ বন্ধ ছিল সবাই বাসায় চলে গেলেন। আমি আর যেতে পারলাম না টাকাও তেমন নাই, বাসায় যাওয়া আসা করতে যত টাকা লাগবে সে টাকা দিয়ে আমার মাসের অর্ধেক খরচ চলে যাবে। সিদ্ধান্ত নিলাম ডিসেম্বর মাসে মেসে বসে পড়ালেখার ঘাটতিগুলো পূরণ করবো ইনশাআল্লাহ। মেসে দেখলাম ২৯ জনের মধ্যে বাসায় যাই এমন ৪/৫ শিক্ষার্থী রইলাম। তখন আমাদের মেসে নতুন আরো একজন উঠলেন, উনি পার্থ দাদা (সরকারী চাকরিজীবী) , সনাতন ধর্মের হলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনে আমাকে বললেন কোন দরকার হলেই উনাকে যেন জানাই। প্রথম বর্ষের রেজাল্ট দিলো আমার জিপিএ ৩.২৫ মাত্র। একটু মনটাও খারাপ হলো এত কম পাইলাম!!
দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হলো। ক্লাসে যাওয়ার পরে এক বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো। উনি আমার পোষাক দেখেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বন্ধু কথাপ্রসঙ্গে বলল ‘ ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনে’ পরীক্ষা দিবে? আমি এই বিষয়ে কিছুই জানিনা তাই সেই বন্ধু সব বুঝিয়ে বলল। তারপর ঐ বন্ধুর মাধ্যমেই অনলাইন রেজিষ্ট্রেশন করলাম পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পরীক্ষাটি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন প্যাটার্ণে। হিসাব করে দেখলাম পরীক্ষার আর মাত্র ৩১ দিন বাকি আছে। আমার তো আগে থেকেই মাস্টার আর জিকে পড়ার অভ্যাস ছিল, মনে মনে একটু সাহস পেলাম আর আমি তখন একাডেমিক পড়া পুরোটাই বন্ধ করে দিয়ে মাস্টার, জিকে আর বাংলা বই পড়তে লাগলাম। এই বৃত্তি পেলেই আমার জীবনের অনেকটা পথ সহজ হয়ে যাবে।আমাদের কাজিপুর থেকে আমি ছাড়াও আরো চারজন ভর্তি হয়েছিল রংপুরে (৪ জন কারমাইকেল কলেজে আর একজন রংপুর সিটি কলেজে) তাদেরকে বৃত্তির ব্যাপারে জানালাম এবং তাদেরও রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য একপ্রকার জোরাজোরি করলাম। টানা ৩১ দিন একাডেমিক কোন পড়া না পড়ে শুধু এডমিশনের বইগুলো পড়লাম। নির্ধারিত তারিখে চার বন্ধু একসাথে পরীক্ষা দিতে গেলাম আর এক বন্ধু গেলো না। পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম পুরো কলেজই পরীক্ষার্থী দিয়ে ভরে গেছে। সারা বাংলাদেশে এমন আরো ৭১ টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হবে (মোট ৭২ টি কেন্দ্র) এবং মোট বৃত্তি দেবে মাত্র ৮১০ জনকে। মনে মনে হিসাব করে দেখলাম বাকী কেন্দ্রগুলোর কথা বাদই দিলাম শুধু রংপুরের কেন্দ্র থেকেই যদি ৮১০ জন নেয় তবুও তো আমার নাম আসবে না। এটা এক প্রকার ধরেই নিলাম এই বৃত্তি আমার হবে না। তবুও আসছি যখন পরীক্ষাটি দিয়েই যাই। পরীক্ষা দিলাম, বাসায় এসে মিলিয়ে দেখলাম মাইনাস মার্কিং বাদে ৭৮-৮১ এমন একটা নাম্বার আশা করা যাচ্ছে। ভাবলাম যারা বৃত্তি পাবে তাদের নম্বর হয়তো ৯০ এর বেশি থাকবে। পরীক্ষা দিয়ে এসে একাডেমিক পড়া শুরু করলাম ১৫/২০ দিন পরেই আবার প্রি- টেস্ট পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষা চলাকালীন একদিন ফোনে মেসেজ আসলো আপনার বৃত্তি পরিক্ষায় প্রদত্ত কিছু ব্যক্তিগত তথ্য অমিল পাওয়া গেছে। আপনি আগামীকাল ‘বায়ান্ন বাংলা’ কোচিং সেন্টারে এসে তথ্য গুলো হালনাগাদ করুন। এই মেসেজটি চার বন্ধুর মধ্যে শুধু আমাকেই দিলো! যথাসময়ে ঐ কোচিং-এ গেলাম গিয়ে দেখি মোটামুটি ২৫০ জন স্টুডেন্টকে এই একই মেসেজ দিয়ে নিয়ে আসছেন রংপুর জেলার সব স্টুডেন্টের মধ্যে থেকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সবাইকে বসিয়ে আবারও ৫০ মার্কের পরীক্ষা নিলেন এবং পরীক্ষা শেষে ভাইবা নিলেন। ভাইভাটা এমন ছিল যেন আমাকে বৃত্তি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, আরো ভালো পরীক্ষা দেওয়া উচিৎ ছিল এসব বলল আর পড়ালেখায় সিরিয়াস হতে বললেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল বৃত্তিটা পাইলে হয়তো ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করতে পারতাম, অবশেষে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলাম না। এসব ভাবতে ভাবতেই মেসে গেলাম।
কিছুদিন পরে ‘ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন’ এর বৃত্তির রেজাল্ট পাবলিশ হলো সকাল ১০.০০ টায়। ঐদিন আমার এক বন্ধুর ফোনে তার রেজাল্ট চলে আসলো দুপুর ১২.০০ টায় (আনুমানিক) উনি “সি” ক্যাটাগরীর বৃত্তি (কোচিং-এ ভর্তির অর্ধেক টাকা দিবে ফাউন্ডেশন থেকে) পেয়েছেন। আরো দুই বন্ধুর রেজাল্ট আসলো বিকাল ৩.০০ টার দিকে (অকৃতকার্য হয়েছেন)। কিন্তু আমার ফোনে রেজাল্ট আসতেছে না। ফোনটা সব সময় কাছাকাছি রাখতেছি যেকোন মেসেজ আসলেই চেক দিচ্ছি কিন্তু সেটা জিপি এসএমএস হয়ে যাচ্ছে! মাগরিবের নামাজ পরার পর এক বন্ধু বলল তুমি তাদের হেল্প লাইন নম্বরে একবার কল দাও। কল দিলাম, ঐপাশ থেকে জানতে চাইলেন কিভাবে হেল্প করতে পারি? আমি বৃত্তির রেজাল্ট জানতে চাইলাম উনি রোল নান্বার শুনে বললেন এই রেজাল্ট শোনার জন্য এতো সিরিয়াস হয়েছেন!! কথাটা খুব বেশি বাজে না হলেও মোটেও এটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কিছু ভয়ভীতিকর কথা বলে…. একটু চুপ থেকে বললেন কংগ্রাচুলেশনস, আপনার “এ” ক্যাটাগরী বৃত্তি হয়েছে। কথাটা শুনে বিশ্বাসই হলো না, কারন এ ক্যাটাগরীর বৃত্তি হলো ঢাকায় ৪ মাসের সকল খরচ ফাউন্ডেশন বহন করবেন সেটা মোটামুটি ৭০০০০৳ টাকার সমমূল্যের বৃত্তি। বললাম স্যার ফোনে তে মেসেজ আসতেছে না? কখন আসবে? বলল বিশ্বাস করেন এটাই আপনার রেজাল্ট একটু ভয় দেখানোর জন্য আগে মজা করলাম, রাত ১২.০০ টার মধ্যেই মেসেজ চলে যাবে। আমি তো মহাখুশি বন্ধুদের বললাম, মেসের সবাই জেনে খুব খুশি হলো। আমি আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের জানাইলাম। তবে একটা দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম, ফাউন্ডেশনে ৮ হাজার টাকা জামানত দিতে হবে। এটা তারা নেওয়ার কারন হলো তাদের থাকা খাওয়া, কোচিং ও বইপত্রের সবকিছু ব্যবস্হা করে রাখা হলেও অনেকে অবিশ্বাস অথবা অবহেলা করে পরে ঢাকায় যান না। ফলে তাদের বৃত্তির টাকা গুলো বিফলে চলে যায় যেহেতু সব কিছুর অগ্রিম টাকা দেন উনারা। আমরা যে যাবো সেই নিশ্চয়তার জন্য এই টাকা নেন। কোচিং শেষে টাকা গুলো ফেরত দিবেন। আমি পরিচিত বড় ভাই ও স্যারদের সাথে এই ব্যাপারে কথা বললাম, প্রায় সবাই বলল এই ৮ হাজার টাকা মেরে দিবে, এগুলো সব মিথ্যা। পরিচিত ভাইদের সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলাম (সাদ্দাম ভাই, রাশেদ ভাই, রাকিব ভাই, রাসেল ভাই, মোস্তফা মামা) ২/১ জন বাদে সবাই বললো ভালো সুযোগ। মেসের ভাইরা বলল এটা ভালো সুযোগ মিস করিও না, এই বৃত্তি পেয়ে গতবছর ফুয়াদ ভাই ঢাকায় তাদের তত্ত্বাবধানে থেকে কোচিং করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় প্রথম হয়েছিল (কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিল)। হাতে এতো টাকাও নাই, বন্ধুদের থেকে আর বড় ভাইদের থেকে ঋণ করে ৮ হাজার টাকা ফাউন্ডেশনে জমা দিলাম। এইচএসসি পরীক্ষার পরেই ঢাকায় তাদের তত্বাবধানে “বর্ণ” কোচিং-এ পড়ালেখা করতে হবে, সবকিছু বলে দিলেন । এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কারনে পড়ালেখায় আবারও ঘাটতি হয়েগেল, প্রি টেস্টেও রেজাল্ট ভালো হলো না, মাত্র ৩.৩৬ পেলাম।
রমজান মাসে বাড়ি চলে গেলাম। এলাকায় সবাই সবুর স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তো বন্ধুদের সাথে আমি রমজান মাসটা সবুর স্যারের কাছেই ইংরেজী প্রাইভেট পড়লাম। মাস শেষ হওয়ার তিনদিন আগেই স্যারকে সম্মানী দিয়ে দিলাম। পরের দিন আমি খেয়া নৌকা আগেই পাওয়ার কারনে সময়ের আগেই চলে গেছিলাম। স্যারও সেদিন একটু আগেই চলে এসে দেখেন আমি একাই বসে আছি। অনেক কিছু আমার সম্পর্কে শুনলেন এবং বললেন তোমার টাকা কালকে ফেরত দিবো। অনেক বার নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি আমার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন “অনেক বড় হও দোয়া করি”। উল্লেখ্য আমাকে বেশিরভাগ শিক্ষকই ফ্রি পড়িয়েছেন এবং পরবর্তীতেও আমাকে অনেক স্যার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন তবে প্রাইভেটের টাকা নিয়ে আবার ফেরত দিয়েছেন শুধু সবুর স্যারই। ঈদের পরে আবার রংপুরে চলে গেলাম।
এইচএসসি পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস বাকি ছিল, একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি এডমিশনের পড়াও আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলাম। লালবাগে ইংরেজি স্যারের কাছে আমি ফ্রীতেই প্রাইভেট পড়তাম (একাডেমিক ইংরেজি)। কিছুদিন পরে স্যার প্রি এডমিশন ব্যাচ চালু করবেন, এখানে কাউকেই ফ্রী পড়ান না, আমি তবুও স্যারকে অনুরোধ করে বললাম স্যার আমাকে আপনি যেকোন একটা কাজ দিয়ে এই ব্যাচে পড়ার সুযোগ করে দেন (যেমন খাতা কাটা, প্রশ্ন তৈরি করা ইত্যাদি যেকোন কাজ)। উনি বললেন তুমি তাহলে প্রতি শুক্রবারে লালবাগের শাখাগুলোতে সাপ্তাহিক পরীক্ষার ব্যাচগুলোতে ৩/৪ ঘন্টা করে সময় দিও। আমি খুব খুশি হলাম তবুও তো স্যার ব্যাচে নিলেন,আমার কাজ হলো পরীক্ষার হলে ডিউটি দেওয়া। কিছুদিন পরেই এইচএসসির ফর্ম ফিলাপ শুরু হলো, এবার খুব দুশ্চিন্তায় পড়লাম, হাতে তো টাকা নাই, যা আছে ম্যাচের খরচই হচ্ছে না। ক্লাস শেষে মেসে আসতেই, কলেজের গেটের সামনে একজন ভদ্রলোক একটা লিফলেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি দেখলাম লেখা ছিল “টাকার জন্য পড়ালেখা বন্ধ হবে না”, প্রয়োজনে কল করুন। বাসায় গিয়ে কল দিলাম ঐপাশ থেকে একটা মেয়ে মানুষের কণ্ঠ আসলো বললো আপনার সমস্যা বলুন। আমার সমস্যা বিস্তারিত শোনার পর বললো ফর্ম ফিলাপের শেষ তারিখ কবে? এটা শুনে বলল আমরা আপনাকে পরে জানাবো বলেই ফোন কেটে দিলেন। এইদিকে আমাকে যারা প্রতিমাসে নির্ধারিত টাকা দিতেন তারাও ২/৩ জন কয়েক মাস ধরে টাকা দিচ্ছেন না। উপায় না পেয়ে একটা ব্যাংকের ম্যানাজারের সাথে পরিচয় ছিল উনাকে কল করে বিস্তারিত বললাম কিন্তু বোধহয় উনি আমাকে বিশ্বাস করলেন না। বললেন এবার সাহায্য করা সম্ভব নয়, তবে সময় হলে কোন একদিন ব্যাংকে যেতে বললেন। আমার যেদিন ফরম ফিলাপের শেষ তারিখ ছিল ঐদিনও অনেকজনকে বলছি। আমার কোন এক আত্মীয় আশ্বাস দিল সকালে টাকা পাঠাবে তাই আমি মেস থেকে বের হলাম আর মেসের খরচবাবদ ২০০০৳ টাকা ছিল সেটা নিয়েই গেলাম। দুঃখের বিষয় আত্মীয়টিকে অনেকগুলো কল করার পরও তিনি আর আমার কল ধরলেন না। মেসের খরচের টাকা দিয়েই ফর্ম ফিলাপ করবো এটা ভেবেই কলেজে গেলাম, অর্ধেক ফর্ম পুরন করছি এমন সময় একটা কল আসলো। হ্যালো বলতেই ঐপাশ থেকে একটা মেয়ে বলল আপনি কোথায় আছেন? বললাম কলেজে ফর্ম ফিলাপ করতে আসছি। বলল টাকা কোথায় পেলেন? বিস্তারিত শোনার পরে বললেন মেইন গেটে আসেন আমরা আপনার ফরম ফিলাপ করে দেব। উনার কথামত গেটে গিয়ে দেখি দুজন ছেলের সাথে একটা সিনিয়র আপু আছেন।আমাকে দেখেই ডাক দিলেন, তুমিই…….। পরে উনি আমার ফর্ম ফিলাপের পুরো টাকা দিলেন আর অতিরিক্ত ১০০০৳ হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র ১৫ দিন আগে এডমিশনের পড়া একদম বন্ধ করে দিলাম। আসলে আমার লক্ষ্য ছিল এইচএসসির রেজাল্ট যেমনই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষায় ভালো কিছু করতেই হবে, না হলে আমার পড়ালেখা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাসায় আসার সময় সেই ব্যাংকের ম্যানাজারের সাথে দেখা করলাম (আমার বোর্ড বৃত্তির টাকা তুলতে গিয়েছিলাম)। আমার সাথে কথা বলে হয়তো মায়া হলো তাই ২০০০৳ টাকা দিয়ে বললেন পড়ালেখার কাজে ব্যয় করিও। বাড়ি এসে আবার ঢাকার উদ্দেশ্য চলে গেলাম, সাথে আমার চাচাতো ভাই মমিন ছিল। আমি বৃত্তি পেয়ে পড়তে গেলাম আর চাচাতো ভাই ভর্তি হলেন নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে। ঢাকায় গিয়ে দেখলাম “এ” ক্যাটাগরীর শিক্ষার্থীদের সব ছেলে গুলোকে এক হোস্টেলেই রাখছে। চাচাতো ভাইকেও আমার হোস্টেলেই রাখা হলো তবে আলাদা ফ্লাটে দিলেন। প্রথম দিনেই অবাক হয়ে গেলাম, ১৭ জন( ‘এ’ ক্যাটাগরী বৃত্তি প্রাপ্ত) ছিল আমাদের ফ্লাটে। সবাই দেখি মোটামুটি আমার থেকে দ্বিগুণ বেশি সময় পড়ালেখা করল। রাতেই সাইফুর রহমান আসলেন (বর্ণ কোচিং-এর পরিচালক), অনেক কথা বললেন….. এখানে যারা আসছো তারা সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার যোগ্য। হাজার হাজার স্টুডেন্টদের মধ্যে থেকে মাত্র ৭০ জনকে এ ক্যাটাগরীর বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। অনেক মোটিভেশনাল কথা বলে উনি চলে গেলেন আর কিছুদিন পরে ঢাবি, জাবি, ঢামেক ও বুয়েট থেকেও সিনিয়রা এসে দিকনির্দেশনা দিলেন। কোচিংয়ের কথা বাদই দিলাম তাদের হোস্টেলগুলোতে খুব কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। মনে মনে ভাবলাম এটা এক প্রকার জেলখানা, নামাজ আর কোচিং ছাড়া বের হতে দেয় না। গেটে একজন বসেই থাকে সবসময়, কখন বের হলাম আর কখন হোস্টেলে ঢুকলাম এবং কেন গিয়েছিলাম সবকিছুর সময় ও বিবরণ লিখে যেতেই হবে। এভাবেই কাটল কোচিংয়ের সময়। ভর্তি ফর্ম তোলার সময় “মানুষ মানুষের জন্য” ফাউন্ডেশন থেকে আমাদের ফর্ম তোলা ও যাতায়াত বাবদ আরো বৃত্তি প্রদান করলেন। নিজেকে যাচাই করা আর মনে সাহস বাড়ানোর জন্য প্রথম পাবলিক পরীক্ষা বাংলাদেশ প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটিতে (বিইউপি) পরীক্ষা দিয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের কথা শুনে সবার পরামর্শে ভর্তি হলাম না। কত কষ্ট করছিলাম ঢাবিতে টপ করার জন্য! ঈদের পরেই ঢাবির পরীক্ষা, পড়ালেখার ক্ষতি হবে এই ভেবে বাড়িতেও গেলাম না। জীবনের প্রথম মা কে ছাড়া একা একা হোস্টেলেই ঈদের দিনটি কাটাইলাম। ঈদের দিন বিকেলবেলা হঠাৎ করেই বাড়ির কথা মনে পড়ল আর মা কে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, একটু পড়েই দেখি চোখের কোন বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তেছে। ঢাবির পরীক্ষার আর মাত্র ৭ দিন বাকি, নিজেকে শক্ত করে আবারো পড়া শুরু করলাম। ঢাবিতে পরীক্ষা দিতে গিয়ে খুভ ভয় কাজ করছিল মনে। এতো স্টুডেন্টদের মধ্যে আমি কি আদৌ চান্স পাবো! ঢাবির পরীক্ষা দেওয়ার পরে হোস্টেলেই যেতে ইচ্ছে করছিল না। হতাশা এতটাই গভীর হয়েছিল যেন এখনই যদি মৃত্যু হয়ে যেতো তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। পরীক্ষায় যা আসছিল কমনই ছিল কিন্তু ভয়ে আর উত্তেজনায় পরীক্ষা খুব খারাপ হয়ে গেল। এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর ভুল করলাম যেগুলো আমি মনে হয় ১৫/২০ বারও পড়েছিলাম। তারপর আর পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারতেছিলাম না অথচ কিছুদিন পরেই আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দিতে হবে। এক প্রকার না পড়েই চট্টগ্রামে আসলাম পরীক্ষা দিতে। চবিতে পড়ার ইচ্ছে ছিল না বলে চবির প্রশ্ন ব্যাংকটাও কেনা হয়নি বস্তুত অনেক দূরের জন্যেই এমনটা ভেবে ছিলাম। পরীক্ষা দিলাম, বি ইউনিটের বাংলা ও জিকে সহজ মনে হলেও ইংরেজিতে তেমন ভালো করতে পারিনি। আমার ধারনা ছিল জীবনের সব পরিশ্রম বিফলে চলে গেল। এনামুল ভাই (এলাকার সিনিয়র ভাই চবিতেই পড়েন) জিজ্ঞেস করল পরীক্ষা কেমন হলো? কোনমতে কিছু একটা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে দিলাম। বিকালে আমরা কুমিল্লায় চলে গেলাম ১ দিন পরেই গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিক্ষা হবে। গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে বুঝলাম এখানে একটু ভালো হয়েছে। তারপর আবার চবিতে আসলাম ১ দিন পরেই চবির ডি ইউনিটে পরীক্ষা হলো, এবার আমার মনের মতো পরীক্ষা হলো। পরীক্ষা দিয়ে রাতেই ট্রেনে ঢাকায় আসলাম। সকালবেলা কোনমতে হোস্টেলে ঢুকেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বাসের মধ্যে থাকাবস্থায় এনামুল ভাইয়ের ফোন পেলাম, চবির বি ইউনিটের রেজাল্ট দিয়েছে! আমি আর আমার চাচাতো ভাইয়ের রোলগুলো দিলাম। মমিনের চান্স হলো না আমার পজিশন ১২৮৪ তম। নিজের রেজাল্টে খুশিই ছিলাম তবে চাচাতো ভাইয়ের অবস্থা দেখে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আমার আম্মু, স্যার, সিনিয়র ভাইসহ সকল নিকট আত্মীয়দের কল দিয়ে সুখবর দিলাম। বাড়ি গিয়ে সবার আনন্দ দেখে মনে হলো আমি এইবার ঈদে বাড়িতে আসিনি তাতে কি হয়েছে! আজকের দিনটাই আমার জন্য ঈদের দিন। কয়েক দিন পরে গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট দিল পজিশন ৬১৮ তম। সবাইকে আবারও সুখবরটা দিলাম। এই খুশির আমেজ শেষ না হতেই আবারও চবির ডি ইউনিটের রেজাল্ট প্রকাশিত হলো পজিশন ১০১ তম। এই রেজাল্ট টা আমাকে অবাক করে দিয়েছিল, পরীক্ষা ভালো হয়েছে তবে এতো ভালো হবে আশাই করি নাই। রাবির পরীক্ষা দিয়ে রংপুরে গেলাম সেই ম্যাডামের সাথে দেখা করতে যিনি আমাকে প্রথম বর্ষ থেকেই খুব অনুপ্রেরণা দিতেন। তারপর সেই পুরোনো মেসে চলে গেলাম, সবাই রেজাল্ট শুনে খুব খুশি হলেন। বাড়ি এসে আবার ঢাবির রেজাল্ট পেলাম পজিশন ১৯৭৯ তম। তারপর রাবির রেজাল্ট পেলাম পজিশন ১১০ তম। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া, এবার মনে হলো আমার পরিশ্রম বৃথা যায়নি, বাংলাদেশের ২৭ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ালেখা করবো, ইনশাআল্লাহ। খুশির আমেজ শেষ হতে না হতেই আবারও চিন্তার ছাপ পড়লো আমার মনে। ভর্তির টাকা কোথায় পাবো! আবারও পাশে দাড়ালেন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ ফাউন্ডেশন, তারা অর্ধেক টাকা দিলেন এবং বাকী অর্ধেক টাকা দিলেন আমাদের চরাঞ্চলের পাবলিকিয়ানদের নিয়ে সংগঠন ‘উসান’। সফলতার কোন শেষ নেই, সফলতা কেবলই একটি প্রচেষ্টা এবং আপেক্ষিক বিষয়। আমার এই প্রচেষ্টায় হাজার হাজার মানুষের অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আমার আম্মুর অবদান অতুলনীয়। তারপরেই আছেন আমার শিক্ষকমন্ডলী এবং আমার কাকারা যারা আমার ছায়াবৃক্ষ ছিলেন। একটা বিষয় আমি সুনিশ্চিত যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তারা নিঃস্বার্থভাবে আমাকে ভালোবাসেন। তাদের সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয় তবে আমি তাদের অবদান সারা জীবনই মনে রাখবো। পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের আমি মাথায় তুলে রাখতে চাই আর যারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সাহায্য করেন নাই তাদের আমি বুকে ধরে রাখতে চাই। বর্তমানে আমি আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করতেছি। সকলের কাছে দোয়ার প্রার্থনা করি, আমি যেন আমার অতীত (শিকড়) ভুলে না যাই………।

Leave a Reply